‘রেজিনা’ ধৃতরাষ্ট্রের বিলাপ
কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ শেষ, কিছুদিন হল তার ফলাফলও স্পষ্ট । প্রাসাদে যখন ধৃতরাষ্ট্রের মুখ অন্ধকার তখন যুদ্ধের ফলাফল বিশ্লেষণে ব্যস্ত নির্মাল্য নাগ
Nirmalya Nag |
|
Fri, Jun 6 2014 |

Photo: Indian Express Archive / Caravan
|
About Nirmalya Nirmalya Nag is a journalist based in Kolkata. His varied interests include photography, watching films and travelling.
 An Enigmatic Beauty  লিস্টিকেল  বরিশালের বাঙাল  My many Kolkata
|
|
কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ শেষ, কিছুক্ষণ হল তার ফলাফলও স্পষ্ট হয়ে গেছে। হস্তিনাপুরের সন্ধ্যার আকাশ রক্তাভ হয়ে আছে। বিজয়ী পান্ডবদের কার্যালয়ে বাজি পুড়িয়ে উৎসব চলছে, সে বাজির আলোতে ঝলমল করে উঠছে চারপাশ। আনন্দকলোচ্ছাসের মাঝে থেকে থেকেই শোনা যাচ্ছে সম্মিলিত ‘নমঃ নমঃ’ ধ্বনি।
ওদিকে নিজের প্রাসাদে ধৃতরাষ্ট্রের মুখ অন্ধকার। সে মুখপানে চেয়ে দীপাধারে রাখা উজ্বল আলোও বিবর্ণ হয়ে গেছে। তিনি জানেন যে বাতায়ন দিয়ে সভাগৃহের রজতশুভ্র গোলাকৃতি চূড়া দেখা যাচ্ছে। তিনি ভাবছেন দশ বছরের আগের এক দিনের কথা। সেদিন রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ এক সর্দারকে ‘চক্রবর্তী রাজা’ আখ্যা দেওয়ায় সারা দেশ তাঁর প্রজ্ঞার ধন্য ধন্য করেছিল। দশ কেন, পাঁচ বছর আগেও উৎসব হয়েছিল কৌরব দলের কার্যালয়ে। পান্ডব শিবির ছিল অন্ধকারে ঢাকা, আর আজ... তাঁর বুক চিরে এক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল।
ভৃত্য এসে সংবাদ দিল সচিব সঞ্জয় মহারাজের সাক্ষাৎপ্রার্থী। যুদ্ধফল স্পষ্ট হওয়ার পর বহুজনকেই ফিরিয়ে দিয়েছেন, তবে এই পার্শ্বচরটিকে তাঁর ভাল লাগে। বড় আম্রভক্ত, আর তার ফলে শরীরে কিঞ্চিৎ মেদ জমেছে বলে ধৃতরাষ্ট্র মাঝে মাঝে সস্নেহে তাকে আমেদ বলেও ডেকে থাকেন। তিনি অনুমতি দিলেন।
পদশব্দে সঞ্জয়ের আগমন বুঝে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “এস সঞ্জয়, আসন গ্রহণ কর।” অভিবাদন জানিয়ে সঞ্জয় বললেন, “রেজিনা রিসপেতাতো,...” “থাক,” থামিয়ে দিলেন কৌরবকূলাধিপতি, আগে এসবে কৌতুক বোধ করতেন, এখন আর করেন না। “ত্রূটিপূর্ণ বিদেশী ভাষায় সম্বোধনের কোনও প্রয়োজন নেই। বিশেষ কোন সংবাদ আছে তো বল।” “মহারাজ, আপনার পুত্র...” “পুত্র! কি হয়েছে তার? শীঘ্র বল।” “উদ্বিগ্ন হবেন না রাজন। মাসাধিককাল ধরে যুদ্ধ করার ক্লান্তি দূর করতে যুবরাজ গুটিকয় সভাসদের সঙ্গে কানামাছি খেলছিলেন। খেলতে খেলতে পড়ে গেছেন, সামান্য আঘাত লেগেছে। চিন্তার কারণ নেই।”
কুরুপ্রধান নিশ্চিন্ত হলেন। বললেন, “যাক...”
সঞ্জয় বললেন, “এতক্ষণ কি ভাবছিলেন, মহারাজ?”
“ভাবছিলাম সত্যিই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। এই সেদিনও রণদামামা শোনা যাচ্ছিল গ্রামে শহরে, নগরে বন্দরে, সমুদ্রে পর্বতে। রথী-মহারথীরা রথচক্রদের তেল আর অশ্বদের ছোলা খাইয়ে আসমুদ্রহিমাচল ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। তাঁদের রথ-নিক্ষিপ্ত ধূলিরাশিতে আর মুখনিসৃত বাক্যশরজালে আকাশ যেন অন্ধকার হয়ে গেছিল।”
“ধন্য মহারাজ! সামান্য কয়েকটি শব্দে আপনি কেমন অপূর্ব বর্ণনা করলেন। ধন্য! হে কুরুকূলভূষণ, যদি অভয় দেন তো বলি, রাজদন্ড গেছে তো কি হয়েছে, আপনি লেখনী ধারণ করুন। দান্তে, পেত্রার্কের পরেই আপনার নাম হবে।”
“আমেদ,” আর্দ্র গলায় বললেন ধৃতরাষ্ট্র। “আবার তুমি বিদেশী লেখকদের নাম নিচ্ছ। কোন ভারতীয়র কথাও তো বলতে পারতে। এই ‘বিদেশী’ শব্দটা আমার জীবনে...”
সঞ্জয় হাতজোড় করলেন। “হে ভারত, অপরাধ মার্জনা করবেন। আপনার মনে আঘাত দিয়ে ফেলেছি। তাও আবার আজকের এই মহাদুঃখের দিনে।”
ধৃতরাষ্ট্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “সঞ্জয়, এ যুদ্ধে জয়লাভের আশা যে দুরাশা, তা ক্রমেই বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু কিছু করতে পারিনি। দৈব আমার সহায় ছিল না, তাছাড়া পুত্রস্নেহে আমি অন্ধ।”
সঞ্জয় বললেন, “কি ভাবে বুঝেছিলেন, মহারাজ?”
ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “বলছি। যখন শুনলাম বঙ্গদেশের রানী আমাদের সহায়তায় এক বনেদী রাজবংশকে পরাজিত করার পর আমাদের বিরুদ্ধাচরণ শুরু করেছে, তখন আর জয়ের আশা করিনি।
“যখন শুনলাম গরিব মানুষের ঘরে দাল-চাউল খেয়ে খেয়ে আমার প্রিয়তম পুত্রের পেটে চরা পড়েছে, তবু ভোটব্যাঙ্কের খরা কাটেনি, তখন আর জয়ের আশা করিনি।
“দাক্ষিণাত্যের এক রাজাকে রাজনৈতিক কারণে মন্ত্রীসভায় স্থান দিইয়েছিলাম। যখন শুনলাম তাকে দূরসঞ্চার প্রযুক্তি নিয়ে দুর্নীতির দায়ে কারাবাসে যেতে হয়েছে, তখন আর জয়ের আশা করিনি।”
সঞ্জয় বললেন, “ওই রাজার প্রিয় সখীকেও তো একই কারণে কারান্তরালে গমন করতে হয়েছে, নরাধিপ।”
ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “তখন থেকেই, সঞ্জয়, জয়ের আশা আর ছিল না। তারপর যখন শুনলাম হিসাব নিকাশের মহাপরীক্ষক শ্রীযুক্ত কাগ মহাশয় জানিয়েছেন কয়লার কালো ব্যবসায়ে বহু লক্ষ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে, তখন আর জয়ের আশা করিনি।
“যখন শুনলাম হস্তিনাপুরে একটি আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা সংগঠিত করতে অমাত্য মহাকালী নানাবিধ দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে দেশের নাম ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন, তখন আর জয়ের আশা করিনি।”
সঞ্জয় বললেন, “ওই সময়ে তো দুই-একটি নির্ণীয়মান সেতুও ধ্বংস হয়েছিল।”
“তাও হয়েছিল,” মহারাজ বলে চললেন, “তারপর যখন শুনলাম সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে যে অর্থ ছড়ানো হয়েছিল, তার কিছু অংশ শত্রুপক্ষের হাত ঘুরে সভায় ফিরে এসেছে, তখন আর জয়ের আশা করিনি।
“যখন শুনলাম বিরোধীপক্ষ সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করেছে পশ্চিমাঞ্চলের এক নরপতিকে, যার বিরুদ্ধে প্রবল প্রচার চালিয়েও খুব একটা লাভ হয়নি, তখন আর জয়ের আশা করিনি।”
সঞ্জয় বললেন, “এই নরপতি তো আপন পত্নীকে ত্যাগ করেছেন –
“পত্নী!! আমাদের পক্ষের রথী মহারথীরা তো যুদ্ধক্ষেত্রই ত্যাগ করলেন, এমনকি যাকে ‘চক্রবর্তি রাজা’ করেছিলাম সেই সর্দারও... কাদের ভরসায় জয়ের আশা করব!
“যখন শুনলাম কন্যাসমা এক মহিলার সঙ্গে আমার প্রিয় অমাত্যটির গোপন প্রেম যুদ্ধকালে প্রকাশ হয়ে গেছে তখন আর জয়ের আশা করিনি।”
একটানা এতক্ষণ কথা বলে ক্লান্ত ধৃতরাষ্ট্র আসনে শরীর এলিয়ে দিলেন। সঞ্জয় ভৃত্যকে আদেশ দিলেন দ্রুত পাখা চালাতে, আসন ছেড়ে উঠে মহারাজের হাতে জলপাত্র এগিয়ে দিলেন। তার পর গিয়ে দাঁড়ালেন উন্মুক্ত বাতায়নের পাশে, দেখলেন অন্ধকার নেমে এসেছে আর সে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে একটি লক্ষ্মীপ্যাঁচা রাজবাড়ির ছাদ থেকে উড়তে উড়তে চলে যাচ্ছে।
Please Sign in or Create a free account to join the discussion
Comments:
Nirmalya Nag (Sunday, Jun 8 2014): @Sugata Sanyal: Thank you sir for your encouraging words. Dr. Sugata Sanyal (Saturday, Jun 7 2014): Nirmalya Nag has used his strong language and unique writing skills and has created a master-piece, yet again. Though the story is based in the Mahabharata era, there is a strong connectivity with the present affairs. Each and every phrase is connected with an incident.The strength lies in his subtle usage of his narration. Editing and illustration is superb as well. I look forward to the day when Nirmalya will point his sword of writing to many social issues and make a global impact.
|
|
|
Popular this month
More from Nirmalya
|